Wednesday, 27 April 2016

প্রেমে পড়লে যা হয় - Bengali love story - preme porle ja hoy

Leave a Comment
প্রেমে পড়লে যা হয় - Bengali love story - preme porle ja hoy

এখন সকাল ন’টা বেজে সাত মিনিট। আহেলি নিজের ঘরে, খাটের উপর বসে আছে। বসে আছে পিঠ সোজা করে। তার চোখমুখ থমথম করছে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে পিঠ সোজা করে, থমথমে মুখে বসে থাকার মানে, কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। জানালার বাইরে কাক ডাকছে ‘কা-কা’ করে। ডেকেই চলেছে। আহেলির ইচ্ছে করল, জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে কাকটার গালে দু’টো চড় কষায়। এটাও মারাত্মক ব্যাপার। কলেজের সেকেন্ড ইয়ারে পড়া কোনও মেয়ের যখন কাককে চড় কষাতে ইচ্ছে করে, তখন বুঝতে হবে, অবস্থা খুবই খারাপ।

ঘটনা তাই। আহেলির অবস্থা খুবই খারাপ। তার মাথায় আগুন জ্বলছে। রাগের আগুন! আগুন লেগেছে বেশ কিছুদিন আগে। নিয়ম হল, রাগের আগুন ধীরে-ধীরে কমবে। আহেলির বেলায়  নিয়ম কাজ করেনি। তার রাগের আগুন বেড়েছে। বনের বদলে মনের ভিতর দাবানলের চেহারা নিয়েছে। রাগ কমানোর কোনও চেষ্টা আহেলি করেনি, এমন নয়। করেছে। গত সাতদিনে সে একটা সার্ভে করেছে। সার্ভের বিষয়, ‘প্রেমে পড়লে কী হয়?’ মোট
১১ জনের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। ভেবেছিল, একডজন করবে। কিন্তু মন এতই খারাপ হয়ে যায় যে, আর এগোয়নি আহেলি। ১১ জনের মধ্যে তার কলেজ এবং টিউশনের বন্ধুরা যেমন আছে, তেমন বাইরের দু’-একজনও আছে। সকলেই নিজেদের অভিজ্ঞতার কথা বলেছে। আহেলির বিরাট আশা ছিল, কারও না-কারও সঙ্গে তার অভিজ্ঞতা মিলবে। বাস্তবে মেলেনি। তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, রাগও চড়চড়িয়ে বেড়েছে।

এই কারণে ঘুম ভাঙার পর পিঠ সোজা করে বসে আহেলি সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, রনিতকে বলে দেবে, আজই বলে দেবে। কিন্তু কীভাবে বলবে? বেশি কথা বলবে, না কম? মনে হচ্ছে, কম বলাই ভাল। শুধু ‘গুডবাই’, নাকি আরও কড়া কিছু? ‘গেট লস্ট’ বা ‘কেটে পড়ো বাপু’ শুনতে খারাপ লাগবে না তো? লাগলে লাগবে! কড়া কথা অবশ্যই দরকার। যে ছেলে ধেড়ে বয়সে… তার জন্য নরম কথা চলে না।
আহেলিকে দেখতে সুন্দর। এখন তাকে আরও সুন্দর লাগছে। সম্ভবত রাগের জন্যই! তবে ‘সুন্দরী’ হয়ে, পিঠ সোজা করে, রাগী মুখে বসে থাকার সময় এটা নয়। এই সময় তার স্নান সেরে ফেলার সময়। তারপর হুড়োহুড়ি করে তৈরি হয়ে, কোনওরকমে নাকে-মুখে খাবার গুঁজে কলেজের উদ্দেশে ছোটার সময়। আজ ফার্স্ট পিরিয়ড টিকেসি-র। মানে, তনিমাকণা চক্রবর্তীর। কঠিন প্রফেসর। তিনি ক্লাস কামাই করা ছাত্রছাত্রীদের জন্য ‘বিশেষ ব্যবস্থা’ রেখেছেন। ক্লাস পরীক্ষার খাতার মাথায় ‘মাইনাস টেন’ বসিয়ে খাতা দেখতে শুরু করেন! এই মাইনাস টেনের ব্যাপারে টিকেসি নির্দয়। একদিন কামাইতেও দশনম্বর কাটা, আবার দশদিন কামাইতেও তাই। এই কারণে ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে আড়ালে ‘টেন টিকেসি’ বলে। তাঁর ক্লাসের কথা ছাত্রছাত্রীরা সবসময় মাথায় রাখে। আগের দিন রাত থেকেই প্রস্তুতি নেয়। কম্পিউটারের সামনে বসে রাত জাগে না, বিছানায় যাওয়ার সময় কানে আইপড নেয় না, মোবাইলে অ্যালার্ম দেয়। মোবাইলের বেশিরভাগ অ্যালার্মই আবার ঘুম পাড়িয়ে দেওয়ার জন্য তৈরি হয়। কোনও-কোনও অ্যালার্মে ঘুম আরও গাঢ় করারও ব্যবস্থা আছে। সেগুলো খুবই জনপ্রিয়। কিন্তু টিকেসির ক্লাসের আগের রাতে ছেলেমেয়েরা নিজেদের মোবাইলে খরখরে ধরনের বিচ্ছিরি আওয়াজের অ্যালার্ম সেট করে। যাতে একবার বাজলেই ধড়ফড় করে উঠে পড়া যায়। তবে এই মুহূর্তে ‘টেন’ কেন, ‘হান্ড্রেড টিকেসি’-র কথাও মাথায় নেই আহেলির। তার কোলে ডায়েরি। বন্ধুদের ইন্টারভিউ। এটাই তার সার্ভে রিপোর্ট। ডায়েরির পাতা ফরফর করে উড়ছে। আহেলি সেদিকে তাকিয়ে আছে। ইচ্ছে করছে, এখনই পাতাগুলো ছিঁড়ে কুটিকুটি করে ফ্যালে… ইন্টারভিউয়ের কতগুলো নমুনা দেওয়া যাক,
ময়ূরী : প্রেমে পড়ে আমি এত খুশি হয়েছি যে, সারাক্ষণ ‘ওর’ জন্য মনকেমন করে। সে যে কী মনকেমন, তুই ভাবতেই পারবি না, আহেলি! একেবারে উথালপাথাল অবস্থা। খালি মনে হয়, কখন ওর সঙ্গে দেখা হবে। ওর পাশে বসেও ওর জন্য মনকেমন করে। কেউ শুনলে ‘ন্যাকা’ বলবে। বলুক! আমার কিছু এসে যায় না। আমার মনকেমন করা মুখের দিকে তাকিয়ে ও বলে, “কী হয়েছে, ময়ূরী?” আমি বলি, “তোমার জন্য মনকেমন করছে। খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।” ও অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে।
পূর্বাশা : আমার প্রেমের সিনড্রোম হল, তেতো সিনড্রোম! উচ্ছে, করলা, নিমপাতার ব্যাপার। আমি ছিলাম মিষ্টির ভক্ত। তেতো দেখলে একশো হাত দূরে পালাতাম, তেতো খাওয়া নিয়ে মায়ের সঙ্গে রোজ খাওয়ার টেব্লে যুদ্ধ হত। প্রেমে পড়ার পর দেখছি, সিচুয়েশন কমপ্লিটলি পালটে গিয়েছে। আজকাল তেতোর জন্য মন হু-হু করে। চেটেপুটে শুক্ত খাই, পরম আরামে চোখ বুজে করলা চিবোই, একবাটি নিমপাতার ঝোল দিলে, একচুমুকে শেষ করে আর-একবাটি চাই! খবর নিয়ে জেনেছি, প্রেমের আনন্দে জিভের টেস্ট বাডগুলোও নাকি বদলে যায়, তেতোকেও মিষ্টি লাগে!
উত্‌সব : প্রেমে পড়ার পর থেকে আমার চেহারায় ভেলকি এসেছে। দুর্বল ভাব, পেটের অসুখ, অ্যাসিডিটি ভ্যানিশ! একটা ঝকঝকে, চকচকে ভাব। মুখ তেলতেলে, যেন সবসময় ক্রিম মেখে ঘুরছি। অনেকেই বলে, “কী রে, উত্‌সব, চেঞ্জে গিয়েছিলি নাকি? বলতে নেই, শরীরটা বেশ লাগছে তোর। চেঞ্জে গেলে ওজন বাড়ে।” আমি লজ্জা পাই। কারণ, আমি দু’দিন আগে দেখেছি, ওজন বেড়ে গিয়েছে। একলাফে তিন কেজি! কাউকে তো আর বলতে পারব না, ওটা আমার নয়, আমার প্রেমের ওজন!
অরিণ্যা : প্রেমে পড়ে আমার খুব একটা লজ্জার ব্যাপার হয়েছে। খালি ইচ্ছে হয় … সরি, বলা যাবে না। (ফিক করে হাসি)।
আদিত্য : প্রেমে পড়ার ফার্স্ট ডে থেকেই আমি লাফিং ডিজ়িজ়ে আক্রান্ত হয়েছি। সেই ডিজ়িজ় চলছে। সর্বক্ষণ হাসি! কখনও জোরে হাসি, কখনও মুচকি হাসি, কখনও মিটমিট করে হাসি। না হাসলেও মুখ হাসি-হাসি হয়ে থাকে। এই তো কিছুদিন আগে ক্লাস টেস্টে ফিজ়িক্সে পেলাম কুড়িতে আড়াই। খাতা হাতে একচোট হাসলাম। স্যার গম্ভীরমুখে বললেন, “মনে হচ্ছে, মাথায় ডিফেক্ট হয়েছে!” আমি মনে-মনে বললাম, ‘অবশ্যই হয়েছে! মাথার গোলমাল দেখা দেওয়া প্রেমে পড়ার সবচেয়ে বড় অ্যাডভান্টেজ। সব ভাল লাগে।”
বন্যা : প্রেমে পড়ে আমার কাঁধের দু’পাশে দু’টো ডানা গজিয়েছে। যখনই অ্যাপো থাকে, আমি উড়ে চলে যাই। যেদিন নিজে উড়তে ইচ্ছে করে না, সেদিন বাস, ট্রাম বা ট্যাক্সি ড্রাইভারকে ডানাজোড়া ধার দিই। তখন ওরাই আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। এই তো সেদিন বৃষ্টিতে খুব জল জমল, একটা রিকশা ডেকে বললাম, “ভাই, এই নাও, ডানাদু’টো কাঁধে ফিট করে নাও, তারপর উড়িয়ে নিয়ে চলো!” রিকশওয়ালাও বেজায় খুশি হয়ে পিঠে ডানা লাগিয়ে সাঁইসাঁই করে উড়তে আরম্ভ করল। সকলে দেখে হাঁ। (ইন্টারভিউ দিতে-দিতে হেসে গড়িয়ে পড়া)।
সার্ভে রিপোর্ট বলছে, প্রেমে পড়ে সকলেই খুশি। আহেলিও খুশি হয়েছিল। কিন্তু সেই খুশি অন্যদের মতো টিকল না। তার কারণ রনিত। সেই রনিত এমন কাণ্ড করতে লাগল…
রনিত ছেলে চমত্‌কার। কম্পিউটার নিয়ে পড়াশোনা করছে। দেখতে লম্বা-চওড়া, ঝকঝকে। রাস্তাঘাটে মেয়েরা আড়চোখে দেখে। মনে হয়, সিরিয়ালের অভিনেতা ভেবে ভুল করে। রনিত এসব পাত্তা দেয় না। তার কথাবার্তাও সুন্দর। বইয়ের পোকা। শনিবার করে থিয়েটার দেখে। তার আইপডে রক, ফোক, ফিল্মের গানের সঙ্গে বেটোফেন, মোত্‌সার্টও রয়েছে। কম্পিউটারে লালন ফকিরের গানের স্টক করছে। নিজে গিটার বাজায়। শুধু গিটার বাজায় না, গান লিখে সুরও দেয়। তবে লজ্জায় কাউকে শোনায় না। আহেলিকে বলেছে, “একদিন শোনাব।” তবে সেই ‘একদিন’ এখনও আসেনি। প্রেমিক হিসেবে এই ছেলে যে দশে দশ নম্বর পাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। প্রথমদিন আলাপেই আহেলি মনে-মনে দিয়েছিল দশে বারো। ইচ্ছে ছিল, পনেরো দেওয়ার। রনিত তাকে প্রপোজ় করার পর আড়াইরাত ঘুমই হয়নি আহেলির। এটা বড় কথা নয়। প্রেমে পড়লে এরকম হয়। ঘুম হয় না। বিছানায় ছটফটানি চলে। পরদিন করমচার মতো লাল-লাল চোখ নিয়ে বেরতে হয়। থেকে-থেকে ঘুম পায়। বাসে, ক্লাসে, ক্যান্টিনে, টিউশনে ঝিমুনি আসে। যারা জানে না, তারা বিরক্ত হয়। যারা জানে, তারা মুখ টিপে হাসে। আহেলির বেলায় আশ্চর্য ব্যাপার হল। রাতে না ঘুমিয়েও সারাদিন সে রইল ঝরঝরে আর চনমনে। নো ঝিমুনি, নো করমচার মতো লাল-লাল চোখ। আহেলির ধারণা ছিল, এটা রনিতের ম্যাজিক।
সেই ম্যাজিক হোঁচট খেল। ক’টাদিন পর রনিতের কাণ্ড দেখে অবাক হল আহেলি। ধেড়ে ছেলের এ কী আচরণ! শুধু ধেড়ে তো নয়, রনিত স্মার্ট, বুদ্ধিমানও বটে। তা হলে? ভারী আশ্চর্য তো! শুধু আশ্চর্যই নয়, মজারও বটে। তবে কিছুদিন যেতে যখন আবার একই ঘটনা ঘটল, তখন বিরক্ত হল আহেলি। রনিতকে বলল, “কী ব্যাপার, বলো তো? তুমি কি চুরি করছ? নাকি ডাকাতি?”
রনিত আমতা-আমতা করে বলল, “ছোটপিসি যদি দেখে ফেলত…”
আহেলি গলায় ঝাঁঝ এনে বলল, “দেখে ফেললে কী হত? এসে তোমার কান মুলে দিত?”
“না, তা নয়, আসলে যদি কিছু ভাবত…”
আহেলি থমকে দাঁড়িয়ে বলল, “কী ভাবত? তুমি প্রেম করছ? ভাবলে ভাবত। তাতে কী হয়েছে? ভাইপোদের প্রেম করা কি অপরাধ?”
রনিত একটু হাসল। হাসিটা হল ক্যাবলা ধরনের। বলল, “যাহ্! কী যে বলো না, আহেলি। ছোটপিসি যদি দেখত প্রেম করছি, আমার সম্পর্কে একটা খারাপ ধারণা তৈরি হত না তার মনে?”
আহেলি হাঁটা শুরু করে বলল, “প্রেম করা খারাপ?”
“তা কেন হবে? প্রেম করা খুবই ভাল। বড়রা বুঝতে চায় না।”
আহেলির খুব রাগ হচ্ছিল। তার একটা কথাও বলতে ইচ্ছে করছিল না। ছোটপিসিকে দেখে রনিত যে তাকে ফেলে অমন লাফ দিয়ে ফুটপাথ বদলাবে, সে ভাবতেও পারেনি। অ্যাক্সিডেন্টও তো হয়ে যেতে পারত। এই ঘটনা আজই প্রথম নয়। প্রথম হয়েছে দশদিন আগে। দশ নয়, এগারোদিন। সেদিন সকাল থেকে অল্প-অল্প বৃষ্টি ছিল। আকাশ মেঘলা। ভেজা-ভেজা ঝোড়ো বাতাস। কফি নিয়ে প্রেম করার জন্য আইডিয়াল দিন। প্ল্যান করেই কফিশপে বসেছিল দু’জনে। আহেলি সবে কফির পেয়ালায় চুমুক দেবে হঠাত্‌, “এই রে! মেজকাকার বন্ধু ঢুকছে,” বলে রনিত লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে, সাঁ করে ওয়াশরুমের দিকে দৌড় দিল। হতভম্ব আহেলি কাচের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল, ক’জন সুট-টাই-পরিহিত লোক গম্ভীর মুখ করে ঢুকল। টেব্লে বসে কফি আর স্যান্ডউইচ খেয়ে দ্রুত বেরিয়ে চলেও গেল। পুরো সময়টা ওয়াশরুমেই কাটিয়ে দিল রনিত। ধেড়ে রনিতের ভয় দেখে আহেলি সেদিন যেমন অবাক হয়েছিল, তেমন মজাও পেয়েছিল। খুব হাসল একচোট। প্রথমদিন তো তাই। পরদিন আর হাসি পেল না। পার্কস্ট্রিটে ‘বুলুদি’-কে দেখতে পেয়ে রনিত শাড়ির দোকানে ঢুকে লুকিয়ে পড়ল। গম্ভীর হয়ে গেল আহেলি। সেইসঙ্গে চিন্তিতও। এ কী ছেলে রে বাবা! রাতে চ্যাট করার সময় সে রনিতকে প্রশ্ন করল, “বুলুদি কে?”
রনিতের জবাব দিল, “আমাদের ফ্ল্যাটে থাকে। থার্ড ফ্লোর, ব্যাক সাইড।”
আহেলি ভুরু কুঁচকে লিখল, “তাকে দেখে লুকিয়ে পড়ার কী ছিল?”
“কী বলছ, আহেলি! যদি দেখে ফেলত!”
আহেলি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে টাইপ করল, “সো হোয়াট?”
“বুলুদি ফ্ল্যাটসুদ্ধ সকলকে বলে বেড়াত। বলে বেড়াত, রনিকে আজ দেখলাম একটা মেয়ের সঙ্গে ঘুরছে।”
বিরক্ত এবং অপমানিত আহেলি এবার লিখল, “এটা কোন সাল তুমি জানো? কোন সেঞ্চুরি?”
রনিতের জবাব, “কেন জানব না?”
“তোমার কাণ্ড দেখে আজ মনে হল, জানো না। মনে হচ্ছে, তুমি বহুবছর আগের কেউ। স্টোন এজের মানুষ। আইস এজও হতে পারে। অবশ্য আইস এজে কোনও বুদ্ধিমান ছেলে ফ্ল্যাটের বুলুদিকে দেখলে এমন নার্ভাস হয়ে যেত বলে আমার মনে হয় না। তোমার কী মনে হয়? যেত? হিস্ট্রি বই কনসাল্ট করতে পারো।”
আহেলি সেদিন হালকা রাগ দেখিয়ে কম্পিউটার বন্ধ করে দিয়েছিল, মোবাইলও। একটু শিক্ষা দেওয়া দরকার। যে ছেলে প্রেমিক হিসেবে দশে বারো নম্বর পায়, তার এ কেমন টেনশন! প্রেম করতে এত ভয়! মেয়েরাও তো আজকাল এরকম করে না। দেবপ্রিয়ার বয়ফ্রেন্ড তো দেবপ্রিয়ার বাড়িতে গিয়েই আড্ডা মারে। আদিত্য কতদিন কলেজ থেকে মোটরবাইকে আয়ুসীকে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে। এমনকী, ওর বাড়িতে খাওয়াদাওয়াও করে ফিরেছে। বিজনদার মা কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছিলেন। সকলের জন্য যেমন গিফ্ট এনেছেন, আনন্দীর জন্যও এনেছেন। নীল পাথর বসানো গলার হার। এসব শুনলে রনিত তো অজ্ঞান হয়ে যাবে। না, ছেলেটাকে বোঝাতে হবে। শুধু রুচি, লেখাপড়া, স্বভাবে ভাল হলেই তো হবে না, প্রেমের ব্যাপারেও স্মার্ট হতে হবে। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। আহেলি ঠিক করল, রনিতকে বোঝাবে। বোঝাবে, এই ভয় জয় করতে হবে।
ক’দিন ধরে আহেলি বোঝাল। বোঝাল কখনও হেসে, কখনও গম্ভীর হয়ে। রনিতও বুঝল। নিজেই বলল, “সত্যি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।  প্রথম প্রেমে পড়েছি তো, প্রেমে ঠিক কী-কী হয় বুঝে উঠতে পারিনি।”
আহেলি চোখ পাকিয়ে বলল, “তার মানে!”
রনিত আওয়াজ করে হেসে উঠল। আহেলিও হাসল। বুঝল, রনিতের ছেলেমানুষি অনেকটা কেটেছে। কিন্তু সেই বোঝা যে কতখানি ভুল বোঝা, আহেলি টের পেয়েছে গত শুক্রবার। আজ থেকে সাতদিন আগে।
সেটা ছিল রনিতের সঙ্গে আহেলির প্রথম সিনেমা যাওয়ার দিন। আহেলির বুক ধুকপুক করছে। একই সঙ্গে উত্তেজনা আর রোমাঞ্চ। অন্ধকার হলে দু’জনে পাশাপাশি বসবে। এক টাব থেকে পপকর্ন খাবে। কথা হবে ফিসফিস করে। কাঁধে কাঁধ লাগবে। হাতে হাত ঠেকবে। ছেলেদের সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি কোনও ব্যাপার নয়। কলেজে তো ছেলেদের সঙ্গে মারপিটও হয়। তাতে বক্সিং, কুস্তিও বাদ থাকে না। কিন্তু রনিত তো আহেলির কাছে শুধু ছেলে নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি। এটাই ধুকপুকুনির কারণ। রনিত টিকিট কেটে ফিরে এলে দু’জনে হলে ঢুকতে গেল, আর তখনই এক মোটাসোটা, গোলগাল মাঝবয়সি মহিলা এগিয়ে এল রনিতের দিকে।
“আরে! রনি না!”
আহেলি চমকে একপা পিছিয়ে গেল। এ আবার কে! রনিত থতমত খেয়ে বলল, “হ্যাঁ, রনি, তবে আপনাকে ঠিক…”
মহিলা একগাল হেসে বললেন, “চিনতে পারছিস না তো? পারবি কী করে? কতদিন পরে দেখছিস, বল তো! আমিও তাই। তখন তুই এইটুকু ছিলি,” হাত দিয়ে মাপ দেখালেন মহিলা। সেই মাপ ফুটদুয়েকের বেশি হবে না। মেরেকেটে আড়াই। আহেলি ইতিমধ্যে আরও সরে গিয়েছে। রনিত মাথা চুলকে বোকার মতো হাসছে। তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে, মহিলাকে সে চিনতে পারেনি।
মহিলা উত্‌সাহ নিয়ে বললেন, “আমি তোর বড়মাসি রে! ডিরেক্ট নয়, তোর মায়ের খুড়তুতো দিদির দূরসম্পর্কের বোন। বালিগঞ্জে থাকি। সেই যে একবার আমাদের বাড়ি গিয়ে একটা ফুলদানি ভেঙেছিলি, মনে পড়ছে? তখন কোন ক্লাসে পড়তিস যেন? থ্রি, না ফোর?”
রনিত বিড়বিড় করে বলল, “আমি… বালিঞ্জের বাড়িতে ফুলদানি…”
মহিলা রনিতের কাঁধে আদরের চাপড় মেরে বললেন, “থাক, আর কষ্ট করে দুষ্টুমির কথা মনে করতে হবে না। বাপ রে, কী লম্বা হয়েছিস! ফুলদি কেমন আছে রে?”
রনিত ঘাড় নেড়ে নার্ভাস গলায় বলল, “মা? মা ভাল আছেন।”
“সিনেমা দেখতে এসেছিস? ভাল করেছিস। তোরা ছেলেমানুষ, তোরা সিনেমা দেখবি না তো কে দেখবে? আমিও নিজের ইচ্ছেয় আসিনি। তোর মেসো জোর করে এনেছে। আমি বললাম, যাব না। ও বলল, একা-একা সিনেমা দেখায় নাকি মজা নেই। বুড়োবয়সে আদিখ্যেতা! তুই তো দিব্যি একা এসেছিস। তাই তো?”
দূরে দাঁড়িয়েই আহেলি শুনতে পেল রনিত কপালের ঘাম মুছে বলল, “হ্যাঁ, একাই এসেছি।”
“ভাল। ফুলদিকে বলিস, ফোন করব। আজকালের মধ্যেই করব। সিনেমা শেষ হলে আমায় ফোন নাম্বার দিয়ে যাবি। এখন দেখি, তোর মেসো টিকিট পেল কি না। যা তুই আনন্দ করে সিনেমা দ্যাখ।”
আনন্দ কোথায়! সিনেমা হলের গদির চেয়ারে কাঠ হয়ে বসে রইল রনিত। যেন তার ফাঁসি  হবে। পপকর্ন, সফ্টড্রিঙ্ক তো দূরের কথা, আগাগোড়া ভান করে গেল, পাশে বসা আহেলিকে সে চেনেই না। একবার শুধু ফিসফিস করে বলল, “চিনতে পারছি না। মনে পড়ছে না।”
আহেলি ঘাড় সোজা করে ফিসফিসিয়ে বলল, “তা হলে এত ভাবছ কেন?”
“আমি না পারি, উনি তো চিনতে পেরেছেন। তোমাকে দেখতে পায় যদি।”
“কী হবে দেখলে!” আহেলি দাঁতে দাঁত ঘষে বলল।
রনিত বিড়বিড় করে বলল, “তুমি বুঝবে না। শুনলে না, মাকে ফোন করবে বলল।”
“করলে কী হবে?”
রনিত কোনও উত্তর দিল না। ইন্টারভ্যালের সময় একছুটে হলের বাইরে পালাল। ফিরল অন্ধকারে, সিনেমা শুরু হওয়ার পর। ততক্ষণে রাগে-দুঃখে চোখ জল এসে গিয়েছে আহেলির। বুঝিয়েও লাভ হল না। মনে হচ্ছে, রনিত এখনও স্কুলে পড়ে। নইলে খুড়তুতো, না মাসতুতো বড়মাসিকে দেখে কেউ ভয়ে কাঁপতে পারে? আহেলি মোটামুটি নিশ্চিন্ত হল, প্রেমের বিষয়ে রনিতের যে অসুখটা আছে, তার নাম ক্যাবলামি! এবার মাথায় আগুন জ্বলল আহেলির। একবার মনে হল, সিনেমা না দেখেই উঠে যায়। তারপর ভাবল, থাক, যা করার পরে করবে, সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে। তবে আসল ঘটনা ঘটল সিনেমা শেষ হওয়ার পর। রনিত আহেলিকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাচ্ছিল। কত দ্রুত এলাকা ছেড়ে সরে পড়া যায়, তার চেষ্টা। আবার আকাশ ফুঁড়ে সামনে এসে দাঁড়ালেন সেই মোটাসোটা, গোলগাল ‘বড়মাসি’। এবার সঙ্গে এক ভদ্রলোক। আহেলি রাগে মুখ ফেরাল। মহিলা অপ্রস্তুত গলায় রনিতকে বললেন, “সরি, একটা ভুল হয়ে গিয়েছে। আসলে আমার বোনপো রনির সঙ্গে তোমায় গুলিয়ে ফেলেছিলাম, ওকে সেই ছোটবেলায় দেখেছি কি না… তোমাকে দেখে রনি ভাবলাম। অনেকটা একরকম চেহারা… একটু আগে আমার হাজ়ব্যান্ডের কাছে শুনলাম, রনি এখন আমেরিকায়। পড়তে গিয়েছে। রনির বাবার সঙ্গে পরশুই তার দেখা হয়েছিল। যাক, কিছু মনে কোরো না, ভাই।”
রাস্তায় নেমে রনিত বলল, “ভেরি সরি, আহেলি। আমারও ভুল হয়ে গিয়েছে। এখন লজ্জা লাগছে।”
আহেলি চুপ করে রইল। রনিত মাথা চুলকে বলল, “আসলে কী জানো, আমার মনে হয়, প্রেমে পড়লে এরকম হয়। অনেক ভুল হয়ে যায়। ভুল না হলে, যেখানে ভয় পাওয়ার কোনও কারণ নেই, সেখানে কেউ ভয় পায়? বলো তুমি?”
আহেলি তাও কিছু বলে না। গত সাতদিনই কিছু বলেনি সে। রনিতের সঙ্গে সব যোগাযোগ বন্ধ রেখেছে। প্রেমে পড়লে কী হয়, তার সার্ভে করেছে। সে রিপোর্ট বলছে, প্রেমে পড়লে আর যা-ই হোক, রনিতের মতো কেউ ভয় পায় না, ক্যাবলাও হয়ে যায় না। এদিকে আহেলির মতো কাউকে মাথায় আগুন জ্বালিয়ে বসে থাকতেও হয় না। অতএব… আহেলি সেলফোনটা হাতে নিয়ে রনিতের নাম্বার ডায়াল করল। বিকেলে কফি হাউসের নীচে আসতে বলবে। সেখানেই ফিনিশ… দ্য এন্ড! ভিতু প্রেমিককে চিরকালের মতো বিদায়! জানালার বাইরে কাকটা এখনও ডাকছে। খাটে বসে কটমট করে তার দিকে তাকাল আহেলি।
কলেজ স্ট্রিট ধরে হাঁটছে রনিত আর আহেলি। আহেলি বকবক করেই চলেছে। সে ভেবেছিল, কথোপকথন ছোট হবে। জাস্ট কাজের কথা। তা আর হল না, কথা বড় হয়ে গেল। সার্ভে রিপোর্টের পুরোটা রনিতকে শোনাল আহেলি। সকালে ‘টেন টিকেসি’-র ক্লাস করতে না পারার জন্য আগামিকাল ক্লাসটেস্টে তার রেজ়াল্ট কতটা খারাপ হতে পারে, সেই আশঙ্কার কথা বলল। সাতদিন ধরে মাথায় আগুন জ্বলে থাকার খবর জানাল। এমনকী, কাকের কথা বলতেও ছাড়ল না। মেজাজ খারাপের সময় কাকের ডাক হল আগুনে ঘি। এর মাঝখানেই রনিত আপ্রাণ চেষ্টা করল বোঝাতে। সে নাকি নিজের গোলমাল ধরতে পেরেছে। মনে সাহস এনে সেই গোলমাল ঠিকও করে নিয়েছে। প্রেমে পড়লে যে এই সব সামান্য ভয়কে তুচ্ছ মনে করতে হয়, হেসে উড়িয়ে দিতে হয়! আর চিন্তা নেই! ছোটপিসি, মেজকাকা, বড়মাসি, বুলুদিরা তাকে আর কাবু করতে পারবে না। আহেলি, রনিতের এই কথায় আমল দিচ্ছে না। সে এই ছেলেকে চিনে গিয়েছে। ভিতু, ক্যাবলা ছেলের সঙ্গে আর যাই হোক, প্রেম করা যায় না। ছেলে চমত্‌কার হলেও নয়। বিবেকানন্দ রোডের মুখে এসে কাজে কথাটা বলতে মুখ তুলল আহেলি, আর তখনই চোখ পড়ল সিগন্যালে আটকে থাকা ট্রামের জানালায়। আঁতকে উঠল সে! ও কে? প্রফেসর টিকেসি না? ঠিকই তো! ওই তো ‘টেন টিকেসি’! চশমা নাকের উপর নামিয়ে কঠিন চোখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। একটাও কথা না বলে, দাঁড়িয়ে থাকা বাসটায় উঠে পড়ল আহেলি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা রনিতকে অবাক করে বাস ছেড়ে দিল হুড়মুড়িয়ে।
রাতে বাড়ি ফিরে আহেলি তার ‘প্রেমে পড়লে কী হয়’ সার্ভে রিপোর্টে নিজের নামটাও যোগ করেছে। পাশে লিখেছে, প্রেমে পড়লে একধরনের ক্যাবলামার্কা, বোকা-বোকা ভয় হয়। সেই ভয়টাই ভাল লাগে!

                                                            লেখক- প্রচেত গুপ্ত

Read More

জীবিত ও মৃত - বাংলা ছোট গল্প - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, Jibito O Mrito - By Rabindranath Tagore full story in bengali

1 comment
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট গল্প- Rabindranath Thakurer Choto golpo
   
        জীবিত ও মৃত


 প্রথম পরিচ্ছেদ:

রানীহাটের জমিদার শারদাশংকরবাবুদের বাড়ির বিধবা বধূটির পিতৃকুলে কেহ ছিল না ; সকলেই একে একে মারা গিয়াছে । পতিকুলেও ঠিক আপনার বলিতে কেহ নাই , পতিও নাই পুত্রও নাই । একটি ভাশুরপো , শারদাশংকরের ছোটো ছেলেটি , সেই তাহার চক্ষের মণি । সে জন্মিবার পর তাহার মাতার বহুকাল ধরিয়া শক্ত পীড়া হইয়াছিল , সেইজন্য এই বিধবা কাকি কাদম্বিনীই তাহাকে মানুষ করিয়াছে । পরের ছেলে মানুষ করিলে তাহার প্রতি প্রাণের টান আরো যেন বেশি হয় , কারণ তাহার উপরে অধিকার থাকে না ; তাহার উপরে কোনো সামাজিক দাবি নাই , কেবল স্নেহের দাবি — কিন্তু কেবলমাত্র স্নেহ সমাজের সমক্ষে আপনার দাবি কোনো দলিল অনুসারে সপ্রমাণ করিতে পারে না এবং চাহেও না , কেবল অনিশ্চিত প্রাণের ধনটিকে দ্বিগুণ ব্যাকুলতার সহিত ভালোবাসে ।
বিধবার সমস্ত রুদ্ধ প্রীতি এই ছেলেটির প্রতি সিঞ্চন করিয়া একদিন শ্রাবণের রাত্রে কাদম্বিনীর অকস্মাৎ মৃত্যু হইল । হঠাৎ কী কারণে তাহার হৃৎস্পন্দন স্তব্ধ হইয়া গেল — সময় জগতের আর-সর্বত্রই চলিতে লাগিল , কেবল সেই স্নেহকাতর ক্ষুদ্র কোমল বক্ষটির ভিতর সময়ের ঘড়ির কল চিরকালের মতো বন্ধ হইয়া গেল ।
পাছে পুলিসের উপদ্রব ঘটে এইজন্য অধিক আড়ম্বর না করিয়া জমিদারের চারিজন ব্রাক্ষ্মণ কর্মচারী অনতিবিলম্বে মৃতদেহ দাহ করিতে লইয়া গেল ।
রানীহাটের শ্মশান লোকালয় হইতে বহুদূরে । পুষ্করিণীর ধারে একখানি কুটির এবং তাহার নিকটে একটা প্রকাণ্ড বটগাছ , বৃহৎ মাঠে আর-কোথাও কিছু নাই । পূর্বে এইখান দিয়া নদী বহিত , এখন নদী একেবারে শুকাইয়া গেছে । সেই শুষ্ক জলপথের এক অংশ খনন করিয়া শ্মশানের পুষ্করিণী নির্মিত হইয়াছে । এখনকার লোকেরা এই পূষ্করিণীকে পূর্ণ স্রোতস্বিনীর প্রতিনিধিস্বরূপ জ্ঞান করে ।
মৃতদেহ কুটিরের মধ্যে স্থাপন করিয়া চিতার কাঠ আসিবার প্রতীক্ষায় চারজনে বসিয়া রহিল । সময় এত দীর্ঘ বোধ হইতে লাগিল যে অধীর হইয়া চারিজনের মধ্যে নিতাই এবং গুরুচরণ কাঠ আনিতে এত বিলম্ব হইতেছে কেন দেখিতে গেল , বিধু এবং বনমালী মৃতদেহ রক্ষা করিয়া বসিয়া রহিল ।
শ্রাবণের অন্ধকার রাত্রি । থম্‌থমে মেঘ করিয়া আছে , আকাশে একটি তারা দেখা যায় না ; অন্ধকার ঘরে দুইজনে চুপ করিয়া বসিয়া রহিল । একজনের চাদরে দিয়াশলাই এবং বাতি বাঁধা ছিল । বর্ষাকালের দিয়াশলাই বহু চেষ্টাতেও জ্বলিল না — যে লণ্ঠন সঙ্গে ছিল তাহাও নিবিয়া গেছে ।
অনেকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া একজন কহিল , “ ভাই রে , এক ছিলিম তামাকের জোগাড় থাকিলে বড়ো সুবিধা হইত । তাড়াতাড়িতে কিছুই আনা হয় নাই । ”
অন্য ব্যক্তি কহিল , “ আমি চট্‌ করিয়া এক দৌড়ে সমস্ত সংগ্রহ করিয়া আনিতে পারি । ”
বনমালীর পলায়নের অভিপ্রায় বুঝিয়া বিধু কহিল , “ মাইরি! আর , আমি বুঝি এখানে একলা বসিয়া থাকিব । ”
আবার কথাবার্তা বন্ধ হইয়া গেল । পাঁচ মিনিটকে এক ঘন্টা বলিয়া মনে হইতে লাগিল । যাহারা কাঠ আনিতে গিয়াছিল তাহাদিগকে মনে মনে ইহারা গালি দিতে লাগিল — তাহারা যে দিব্য আরামে কোথাও বসিয়া গল্প করিতে করিতে তামাক খাইতেছে , এ সন্দেহ ক্রমশই তাহাদের মনে ঘনীভূত হইয়া উঠিতে লাগিল ।
কোথাও কিছু শব্দ নাই — কেবল পুষ্করিণীতীর হইতে অবিশ্রাম ঝিল্লি এবং ভেকের ডাক শুনা যাইতেছে । এমন সময়ে মনে হইল যেন খাটটা ঈষৎ নড়িল- যেন মৃতদেহ পাশ ফিরিয়া শুইল ।
বিধু এবং বনমালী রামনাম জপিতে জপিতে কাঁপিতে লাগিল । হঠাৎ ঘরের মধ্যে একটা দীর্ঘনিশ্বাস শুনা গেল । বিধু এবং বনমালী এক মুহূর্তে ঘর হইতে লম্ফ দিয়া বাহির হইয়া গ্রামের অভিমুখে দৌড় দিল ।
প্রায় ক্রোশ-দেড়েক পথ গিয়া দেখিল তাহাদের অবশিষ্ট দুই সঙ্গী লণ্ঠন হাতে ফিরিয়া আসিতেছে । তাহারা বাস্তবিকই তামাক খাইতে গিয়াছিল , কাঠের কোনো খবর জানে না , তথাপি সংবাদ দিল, গাছ কাটিয়া কাঠ ফাড়াইতেছে — অনতিবিলম্বে রওনা হইবে । তখন বিধু এবং বনমালী কুটিরের সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করিল । নিতাই এবং গুরুচরণ অবিশ্বাস করিয়া উড়াইয়া দিল , এবং কর্তব্য ত্যাগ করিয়া আসার জন্য অপর দুইজনের প্রতি অত্যন্ত রাগ করিয়া বিস্তর ভর্ৎসনা করিতে লাগিল ।
কালবিলম্ব না করিয়া চারজনেই শ্মশানে সেই কুটিরে গিয়া উপস্থিত হইল । ঘরে ঢুকিয়া দেখিল মৃতদেহ নাই , শূন্য খাট পড়িয়া আছে ।
পরস্পর মুখ চাহিয়া রহিল । যদি শৃগালে লইয়া গিয়া থাকে ? কিন্তু আচ্ছাদনবস্ত্রটি পর্যন্ত নাই । সন্ধান করিতে করিতে বাহিরে গিয়া দেখে কুটিরের দ্বারের কাছে খানিকটা কাদা জমিয়াছিল , তাহাতে স্ত্রীলোকের সদ্য এবং ক্ষুদ্র পদচিহ্ন ।
শারদাশংকর সহজ লোক নহেন , তাঁহাকে এই ভূতের গল্প বলিলে হঠাৎ যে কোনো শুভফল পাওয়া যাইবে এমন সম্ভাবনা নাই । তখন চারজনে বিস্তর পরামর্শ করিয়া স্থির করিল যে, দাহকার্য সমাধা হইয়াছে এইরূপ খবর দেওয়াই ভালো ।
ভোরের দিকে যাহারা কাঠ লইয়া আসিল তাহারা সংবাদ পাইল , বিলম্ব দেখিয়া পূর্বেই কার্য শেষ করা হইয়াছে , কুটিরের মধ্যে কাষ্ঠ সঞ্চিত ছিল । এ সম্বন্ধে কাহারো সহজে সন্দেহ উপস্থিত হইতে পারে না — কারণ , মৃতদেহ এমন-কিছু বহুমূল্য সম্পত্তি নহে যে কেহ ফাঁকি দিয়া চুরি করিয়া লইয়া যাইবে ।

 দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ:

সকলেই জানেন , জীবনের যখন কোনো লক্ষণ পাওয়া যায় না তখনো অনেক সময় জীবন প্রচ্ছন্নভাবে থাকে , এবং সময়মতো পুনর্বার মৃতবৎ দেহে তাহার কার্য আরম্ভ হয় । কাদম্বিনীও মরে নাই — হঠাৎ কী কারণে তাহার জীবনের ক্রিয়া বন্ধ হইয়া গিয়াছিল ।
যখন সে সচেতন হইয়া উঠিল , দেখিল, চতুর্দিকে নিবিড় অন্ধকার । চিরাভ্যাসমতো যেখানে শয়ন করিয়া থাকে , মনে হইল, এটা সে জায়গা নহে । একবার ডাকিল ‘ দিদি '— অন্ধকার ঘরে কেহ সাড়া দিল না । সভয়ে উঠিয়া বসিল , মনে পড়িল সেই মৃত্যুশয্যার কথা । সেই হঠাৎ বক্ষের কাছে একটি বেদনা — শ্বাসরোধের উপক্রম । তাহার বড়ো জা ঘরের কোণে বসিয়া একটি অগ্নিকুণ্ডের উপরে খোকার জন্য দুধ গরম করিতেছে — কাদম্বিনী আর দাঁড়াইতে না পারিয়া বিছানার উপর আছাড় খাইয়া পড়িল — রুদ্ধকন্ঠে কহিল , " দিদি , একবার খোকাকে আনিয়া দাও- আমার প্রাণ কেমন করিতেছে । " তাহার পর সমস্ত কালো হইয়া আসিল — যেন একটি লেখা খাতার উপরে দোয়াতসুদ্ধ কালি গড়াইয়া পড়িল — কাদম্বিনীর সমস্ত স্মৃতি এবং চেতনা , বিশ্বগ্রন্থের সমস্ত অক্ষর এক মুহূর্তে একাকার হইয়া গেল । খোকা তাহাকে একবার শেষবারের মতো তাহার সেই সুমিষ্ট ভালোবাসার স্বরে কাকিমা বলিয়া ডাকিয়াছিল কি না , তাহার অনন্ত অজ্ঞাত মরণযাত্রার পথে চিরপরিচিত পৃথিবী হইতে এই শেষ স্নেহপাথেয়টুকু সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিল কি না বিধবার তাহাও মনে পড়ে না ।
প্রথমে মনে হইল , যমালয় বুঝি এইরূপ চিরনির্জন এবং চিরান্ধকার । সেখানে কিছুই দেখিবার নাই , শুনিবার নাই , কাজ করিবার নাই , কেবল চিরকাল এইরূপ জাগিয়া উঠিয়া বসিয়া থাকিতে হইবে ।
তাহার পর যখন মুক্তদ্বার দিয়া হঠাৎ একটা ঠাণ্ডা বাদলার বাতাস দিল এবং বর্ষার ভেকের ডাক কানে প্রবেশ করিল, তখন এক মূহূর্তে তাহার এই স্বল্প জীবনের আশৈশব সমস্ত বর্ষার স্মৃতি ঘনীভূতভাবে তাহার মনে উদয় হইল এবং পৃথিবীর নিকটসংস্পর্শ সে অনুভব করিতে পারিল । একবার বিদ্যুৎ চমকিয়া উঠিল ; সম্মুখে পুষ্করিণী , বটগাছ , বৃহৎ মাঠ এবং সুদূর তরুশ্রেণী এক পলকে চোখে পড়িল । মনে পড়িল , মাঝে মাঝে পুণ্য তিথি উপলক্ষে এই পুষ্করিণীতে আসিয়া স্নান করিয়াছে , এবং মনে পড়িল সেই সময়ে এই শ্মশানে মৃতদেহ দেখিয়া মৃত্যুকে কী ভয়ানক মনে হইত ।
প্রথমে মনে হইল , বাড়ি ফিরিয়া যাইতে হইবে । কিন্তু তখনই ভাবিল , আমি তো বাঁচিয়া নাই , আমাকে বাড়িতে লইবে কেন । সেখানে যে অমঙ্গল হইবে । জীবরাজ্য হইতে আমি যে নির্বাসিত হইয়া আসিয়াছি — আমি যে আমার প্রেতাত্মা ।
তাই যদি না হইবে তবে সে এই অর্ধরাত্রে শারদাশংকরের সুরক্ষিত অন্তঃপুর হইতে এই দুর্গম শ্মশানে আসিল কেমন করিয়া । এখনো যদি তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষ না হইয়া থাকে তবে দাহ করিবার লোকজন গেল কেথায়? শারদাশংকরের আলোকিত গৃহে তাহার মৃত্যুর শেষ মুহূর্ত মনে পড়িল , তাহার পরেই এই বহুদূরবর্তী জনশূন্য অন্ধকার শ্মশানের মধ্যে আপনাকে একাকিনী দেখিয়া সে জানিল , আমি এই পৃথিবীর জনসমাজের আর কেহ নহি — আমি অতি ভীষণ , অকল্যাণকারিণী ; আমি আমার প্রেতাত্মা ।
এই কথা মনে উদয় হইবামাত্রই তাহার মনে হইল , তাহার চতুর্দিক হইতে বিশ্বনিয়মের সমস্ত বন্ধন যেন ছিন্ন হইয়া গিয়াছে । যেন তাহার অদ্ভুত শক্তি , অসীম স্বাধীনতা — যেখানে ইচ্ছা যাইতে পারে , যাহা ইচ্ছা করিতে পারে । এই অভূতপূর্ব নূতন ভাবের আবির্ভাবে সে উন্মত্তের মতো হইয়া হঠাৎ একটা দমকা বাতাসের মতো ঘর হইতে বাহির হইয়া অন্ধকার শ্মশানের উপর দিয়া চলিল — মনে লজ্জা ভয় ভাবনার লেশমাত্র রহিল না ।
চলিতে চলিতে চরণ শ্রান্ত , দেহ দুর্বল হইয়া আসিতে লাগিল । মাঠের পর মাঠ আর শেষ হয় না — মাঝে মাঝে ধান্যক্ষেত্র- কোথাও বা এক-হাঁটু জল দাঁড়াইয়া আছে । যখন ভোরের আলো অল্প অল্প দেখা দিয়াছে তখন অদূরে লোকালয়ের বাঁশঝাড় হইতে দুটো-একটা পাখির ডাক শুনা গেল ।
তখন তাহার কেমন ভয় করিতে লাগিল । পৃথিবীর সহিত জীবিত মনুষ্যের সহিত এখন তাহার কিরূপ নূতন সম্পর্ক দাঁড়াইয়াছে সে কিছু জানে না । যতক্ষণ মাঠে ছিল , শ্মশানে ছিল , শ্রাবণরজনীর অন্ধকারের মধ্যে ছিল ততক্ষণ সে যেন নির্ভয়ে ছিল , যেন আপন রাজ্যে ছিল । দিনের আলোকে লোকালয় তাহার পক্ষে অতি ভয়ংকর স্থান বলিয়া বোধ হইল । মানুষ ভূতকে ভয় করে , ভূতও মানুষকে ভয় করে , মৃত্যুনদীর দুই পারে দুইজনের বাস ।

 তৃতীয় পরিচ্ছেদ:

কাপড়ে কাদা মাখিয়া , অদ্ভুত ভাবের বশে ও রাত্রিজাগরণে পাগলের মতো হইয়া , কাদম্বিনীর যেরূপ চেহারা হইয়াছিল তাহাতে মানুষ তাহাকে দেখিয়া ভয় পাইতে পারিত এবং ছেলেরা বোধ হয় দূরে পালাইয়া গিয়া তাহাকে ঢেলা মারিত । সৌভাগ্যক্রমে একটি পথিক ভদ্রলোক তাহাকে সর্বপ্রথমে এই অবস্থায় দেখিতে পায় ।
সে আসিয়া কহিল , “ মা , তোমাকে ভদ্রকুলবধূ বলিয়া বোধ হইতেছে , তুমি এ অবস্থায় একলা পথে কোথায় চলিয়াছ । ”
কাদম্বিনী প্রথমে কোনো উত্তর না দিয়া তাকাইয়া রহিল । হঠাৎ কিছুই ভাবিয়া পাইল না । সে যে সংসারের মধ্যে আছে , তাহাকে যে ভদ্রকুলবধূর মতো দেখাইতেছে , গ্রামের পথে পথিক তাহাকে যে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেছে , এ-সমস্তই তাহার কাছে অভাবনীয় বলিয়া বোধ হইল ।
পথিক তাহাকে পুনশ্চ কহিল , “ চলো মা , আমি তোমাকে ঘরে পৌঁছাইয়া দিই — তোমার বাড়ি কোথায় আমাকে বলো।”
কাদম্বিনী চিন্তা করিতে লাগিল । শ্বশুরবাড়ি ফিরিবার কথা মনে স্থান দেওয়া যায় না , বাপের বাড়ি তো নাই — তখন ছেলেবেলার সইকে মনে পড়িল ।
সই যোগমায়ার সহিত যদিও ছেলেবেলা হইতেই বিচ্ছেদ তথাপি মাঝে মাঝে চিঠিপত্র চলে । এক-একসময় রীতিমত ভালোবাসার লড়াই চলিতে থাকে — কাদম্বিনী জানাইতে চাহে ভালোবাসা তাহার দিকেই প্রবল; যোগমায়া জানাইতে চাহে কাদম্বিনী তাহার ভালোবাসার যথোপযুক্ত প্রতিদান দেয় না । কোনো সুযোগে একবার উভয়ে মিলন হইতে পারিলে যে একদণ্ড কেহ কাহাকে চোখের আড়াল করিতে পারিবে না, এ বিষয়ে কোনো পক্ষেরই কোনো সন্দেহ ছিল না ।
কাদম্বিনী ভদ্রলোকটিকে কহিল , “ নিশিন্দাপুরে শ্রীপতিচরণবাবুর বাড়ি যাইব । ”
পথিক কলিকাতায় যাইতেছিলেন ; নিশিন্দাপুর যদিও নিকটবর্তী নহে তথাপি তাঁহার গম্য পথেই পড়ে । তিনি স্বয়ং বন্দোবস্ত করিয়া কাদম্বিনীকে শ্রীপতিচরণবাবুর বাড়ি পৌঁছাইয়া দিলেন ।
দুই সইয়ে মিলন হইল । প্রথমে চিনিতে একটু বিলম্ব হইয়াছিল , তার পরে বাল্যসাদৃশ্য উভয়ের চক্ষে ক্রমশই পরিষ্ফুট হইয়া উঠিল ।
যোগমায়া কহিল , “ ওমা , আমার কী ভাগ্য । তোমার যে দর্শন পাইব এমন তো আমার মনেই ছিল না । কিন্তু, ভাই , তুমি কী করিয়া আসিলে । তোমার শ্বশুরবাড়ির লোকেরা যে তোমাকে ছাড়িয়া দিল! ”
কাদম্বিনী চুপ করিয়া রহিল, অবশেষে কহিল , “ ভাই , শ্বশুরবাড়ির কথা আমাকে জিজ্ঞাসা করিয়ো না । আমাকে দাসীর মতো বাড়ির একপ্রান্তে স্থান দিয়ো , আমি তোমাদের কাজ করিয়া দিব । ”
যোগমায়া কহিল , “ ওমা , সে কী কথা । দাসীর মতো থাকিবে কেন । তুমি আমার সই , তুমি আমার —” ইত্যাদি ।
এমন সময় শ্রীপতি ঘরে প্রবেশ করিল । কাদম্বিনী খানিকক্ষণ তাহার মুখের দিকে তাকাইয়া ধীরে ধীরে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল — মাথায় কাপড় দেওয়া , বা কোনোরূপ সংকোচ বা সম্ভ্রমের লক্ষণ দেখা গেল না ।
পাছে তাহার সইয়ের বিরুদ্ধে শ্রীপতি কিছু মনে করে , এজন্য ব্যস্ত হইয়া যোগমায়া নানারূপে তাহাকে বুঝাইতে আরম্ভ করিল । কিন্তু, এতই অল্প বুঝাইতে হইল এবং শ্রীপতি এত সহজে যোগমায়ার সমস্ত প্রস্তাবে অনুমোদন করিল যে , যোগমায়া মনে মনে বিশেষ সন্তুষ্ট হইল না ।
কাদম্বিনী সইয়ের বাড়িতে আসিল , কিন্তু সইয়ের সঙ্গে মিশিতে পারিল না — মাঝে মৃত্যুর ব্যবধান । আত্মসম্বন্ধে সর্বদা একটা সন্দেহ এবং চেতনা থাকিলে পরের সঙ্গে মেলা যায় না- কাদম্বিনী যোগমায়ার মুখের দিকে চায় এবং কী যেন ভাবে — মনে করে , স্বামী এবং ঘরকন্না লইয়া ও যেন বহুদূরে আর-এক জগতে আছে । স্নেহ-মমতা এবং সমস্ত কর্তব্য লইয়া ও যেন পৃথিবীর লোক , আর আমি যেন শূন্য ছায়া । ও যেন অস্তিত্বের দেশে আর আমি যেন অনন্তের মধ্যে ।
যোগমায়ারও কেমন কেমন লাগিল , কিছুই বুঝিতে পারিল না । স্ত্রীলোক রহস্য সহ্য করিতে পারে না- কারণ অনিশ্চিতকে লইয়া কবিত্ব করা যায় , বীরত্ব করা যায় , পাণ্ডিত্য করা যায় , কিন্তু ঘরকন্না করা যায় না । এইজন্য স্ত্রীলোক যেটা বুঝিতে পারে না , হয় সেটার অস্তিত্ব বিলোপ করিয়া তাহার সহিত কোনো সম্পর্ক রাখে না , নয় তাহাকে স্বহস্তে নূতন মূর্তি দিয়া নিজের ব্যবহারযোগ্য একটি সামগ্রী গড়িয়া তোলে — যদি দুইয়ের কোনোটাই না পারে তবে তাহার উপর ভারি রাগ করিতে থাকে ।
কাদম্বিনী যতই দুর্বোধ হইয়া উঠিল, যোগমায়া তাহার উপর ততই রাগ করিতে লাগিল, ভাবিল , এ কী উপদ্রব স্কন্ধের উপর চাপিল ।
আবার আর-এক বিপদ । কাদম্বিনীর আপনাকে আপনি ভয় করে । সে নিজের কাছ হইতে নিজে কিছুতেই পলাইতে পারে না । যাহাদের ভূতের ভয় আছে তাহারা আপনার পশ্চাদ্দিককে ভয় করে — যেখানে দৃষ্টি রাখিতে পারে না সেইখানেই ভয় । কিন্তু , কাদম্বিনীর আপনার মধ্যেই সর্বাপেক্ষা বেশি ভয়- বাহিরে তার ভয় নাই ।
এইজন্য বিজন দ্বিপ্রহরে সে একা ঘরে এক-একদিন চীৎকার করিয়া উঠিত- এবং সন্ধ্যাবেলায় দীপালোকে আপনার ছায়া দেখিলে তাহার গা ছম্‌ছম্‌ করিতে থাকিত ।
তাহার এই ভয় দেখিয়া বাড়িসুদ্ধ লোকের মনে কেমন একটা ভয় জন্মিয়া গেল । চাকরদাসীরা এবং যোগমায়াও যখন-তখন যেখানে-সেখানে ভূত দেখিতে আরম্ভ করিল ।
একদিন এমন হইল , কাদম্বিনী অর্ধরাত্রে আপন শয়নগৃহ হইতে কাঁদিয়া বাহির হইয়া একেবারে যোগমায়ার গৃহদ্বারে আসিয়া কহিল , “ দিদি , দিদি , তোমার দুটি পায়ে পড়ি গো! আমায় একলা ফেলিয়া রাখিয়ো না । ”
যোগমায়ার যেমন ভয়ও পাইল তেমনি রাগও হইল । ইচ্ছা করিল তদ্দণ্ডেই কাদম্বিনীকে দূর করিয়া দেয় । দয়াপরবশ শ্রীপতি অনেক চেষ্টায় তাহাকে ঠাণ্ডা করিয়া পার্শ্ববর্তী গৃহে স্থান দিল ।
পরদিন অসময়ে অন্তঃপুরে শ্রীপতির তলব হইল । যোগমায়া তাহাকে অকস্মাৎ ভর্ৎসনা করিতে আরম্ভ করিল , “ হাঁ গা , তুমি কেমনধারা লোক। একজন মেয়েমানুষ আপন শ্বশুরঘর ছাড়িয়া তোমার ঘরে আসিয়া অধিষ্ঠান হইল , মাসখানেক হইয়া গেল তবু যাইবার নাম করে না , আর তোমার মুখে যে একটি আপত্তিমাত্র শুনি না! তোমার মনের ভাবটা কী বুঝাইয়া বলো দেখি । তোমরা পুরুষমানুষ এমনি জাতই বটে । ”
বাস্তবিক, সাধারণ স্ত্রীজাতির ' পরে পুরুষমানুষের একটা নির্বিচার পক্ষপাত আছে এবং সেজন্য স্ত্রীলোকেরাই তাহাদিগকে অধিক অপরাধী করে । নিঃসহায়া অথচ সুন্দরী কাদম্বিনীর প্রতি শ্রীপতির করুণা যে যথোচিত মাত্রার চেয়ে কিঞ্চিৎ অধিক ছিল তাহার বিরুদ্ধে তিনি যোগমায়ার গাত্রস্পর্শপূর্বক শপথ করিতে উদ্যত হইলেও তাঁহার ব্যবহারে তাহার প্রমাণ পাওয়া যাইত ।
তিনি মনে করিতেন , ‘ নিশ্চয়ই শ্বশুরবাড়ির লোকেরা এই পুত্রহীনা বিধবার প্রতি অন্যায় অত্যাচার করিত , তাই নিতান্ত সহ্য করিতে না পারিয়া পলাইয়া কাদম্বিনী আমার আশ্রয় লইয়াছে । যখন ইহার বাপ মা কেহই নাই , তখন আমি ইহাকে কী করিয়া ত্যাগ করি । ' এই বলিয়া তিনি কোনোরূপ সন্ধান লইতে ক্ষান্ত ছিলেন এবং কাদম্বিনীকেও এই অপ্রীতিকর বিষয়ে প্রশ্ন করিয়া ব্যথিত করিতে তাঁহার প্রবৃত্তি হইত না ।
তখন তাঁহার স্ত্রী তাঁহার অসাড় কর্তব্যবুদ্ধিতে নানাপ্রকার আঘাত দিতে লাগিল । কাদম্বিনীর শ্বশুরবাড়িতে খবর দেওয়া যে তাঁহার গৃহের শান্তিরক্ষার পক্ষে একান্ত আবশ্যক , তাহা তিনি বেশ বুঝিতে পারিলেন । অবশেষে স্থির করিলেন , হঠাৎ চিঠি লিখিয়া বসিলে ভালো ফল না ' ও হইতে পারে , অতএব রানীহাটে তিনি নিজে গিয়া সন্ধান লইয়া যাহা কর্তব্য স্থির করিবেন ।
শ্রীপতি তো গেলেন , এদিকে যোগমায়া আসিয়া কাদম্বিনীকে কহিল , “ সই , এখানে তোমার আর থাকা ভালো দেখাইতেছে না । লোকে বলিবে কী । ”
কাদম্বিনী গম্ভীরভাবে যোগমায়ার মুখের দিকে তাকাইয়া কহিল , “ লোকের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী । ”
যোগমায়া কথা শুনিয়া অবাক হইয়া গেল । কিঞ্চিৎ রাগিয়া কহিল , “ তোমার না থাকে , আমাদের তো আছে । আমরা পরের ঘরের বধূকে কী বলিয়া আটক করিয়া রাখিব । ”
কাদম্বিনী কহিল , “ আমার শ্বশুরঘর কোথায় । ”
যোগমায়া ভাবিল , ‘ আ মরণ! পোড়াকপালী বলে কী। '
কাদম্বিনী ধরে ধীরে কহিল , “ আমি কি তোমাদের কেহ । আমি কি এ পৃথিবীর । তোমরা হাসিতেছ , কাঁদিতেছ , ভালোবাসিতেছ , সবাই আপন আপন লইয়া আছ , আমি তো কেবল চাহিয়া আছি । তোমরা মানুষ , আর আমি ছায়া । বুঝিতে পারি না , ভগবান আমাকে তোমাদের এই সংসারের মাঝখানে কেন রাখিয়াছেন । তোমরাও ভয় কর পাছে তোমাদের হাসিখেলার মধ্যে আমি অমঙ্গল আনি — আমিও বুঝিয়া উঠিতে পারি না , তোমাদের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক । কিন্তু, ঈশ্বর যখন আমাদের জন্য আর-কোনো স্থান গড়িয়া রাখেন নাই , তখন কাজে-কাজেই বন্ধন ছিঁড়িয়া যায় তবু তোমাদের কাছেই ঘুরিয়া ঘুরিয়া বেড়াই । ”
এমনি ভাবে চাহিয়া কথাগুলা বলিয়া গেল যে , যোগমায়া কেমন একরকম করিয়া মোটের উপর একটা কী বুঝিতে পারিল, কিন্তু আসল কথাটা বুঝিল না , জবাবও দিতে পারিল না । দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করিতেও পারিল না । অত্যন্ত ভারগ্রস্ত গম্ভীর ভাবে চলিয়া গেল ।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ:

রাত্রি প্রায় যখন দশটা তখন শ্রীপতি রানীহাট হইতে ফিরিয়া আসিলেন । মুষলধারে বৃষ্টিতে পৃথিবী ভাসিয়া যাইতেছে । ক্রমাগতই তাহার ঝর্ ঝর্ শব্দে মনে হইতেছে , বৃষ্টির শেষ নাই , আজ রাত্রিরও শেষ নাই ।
যোগমায়া জিজ্ঞাসা করিলেন , “ কী হইল । ”
শ্রীপতি কহিলেন , “ সে অনেক কথা । পরে হইবে । ” বলিয়া কাপড় ছাড়িয়া আহার করিলেন এবং তামাক খাইয়া শুইতে গেলেন । ভাবটা অত্যন্ত চিন্তিত ।
যোগমায়া অনেক ক্ষণ কৌতূহল দমন করিয়া ছিলেন , শয্যায় প্রবেশ করিয়াই জিজ্ঞাসা করিলেন , “ কী শুনিলে, বলো । ”
শ্রীপতি কহিলেন , “ নিশ্চয় তুমি একটা ভুল করিয়াছ । ”
শুনিবামাত্র যোগমায়া মনে মনে ঈষৎ রাগ করিলেন । ভুল মেয়েরা কখনোই করে না; যদি-বা করে কোনো সুবুদ্ধি পুরুষের সেটা উল্লেখ করা কর্তব্য হয় না , নিজের ঘাড় পাতিয়া লওয়াই সুযুক্তি । যোগমায়া কিঞ্চিৎ উষ্ণভাবে কহিলেন , “ কিরকম শুনি । ”
শ্রীপতি কহিলেন , “ যে স্ত্রীলোকটিকে তোমার ঘরে স্থান দিয়াছ সে তোমার সই কাদম্বিনী নহে । ”
এমনতরো কথা শুনিলে সহজেই রাগ হইতে পারে — বিশেষত নিজের স্বামীর মুখে শুনিলে তো কথাই নাই । যোগমায়া কহিলেন , “ আমার সইকে আমি চিনি না , তোমার কাছ হইতে চিনিয়া লইতে হইবে — কী কথার শ্রী । ”
শ্রীপতি বুঝাইলেন, এস্থলে কথার শ্রী লইয়া কোনোরূপ তর্ক হইতেছে না , প্রমাণ দেখিতে হইবে । যোগমায়ার সই কাদম্বিনী যে মারা গিয়াছে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই ।
যোগমায়া কহিলেন , “ ঐ শোনো। তুমি নিশ্চয় একটা গোল পাকাইয়া আসিয়াছ । কোথায় যাইতে কোথায় গিয়াছ , কী শুনিতে কী শুনিয়াছ তাহার ঠিক নাই । তোমাকে নিজে যাইতে কে বলিল , একখানা চিঠি লিখিয়া দিলেই সমস্ত পরিষ্কার হইত । ”
নিজের কর্মপটুতার প্রতি স্ত্রীর এইরূপ বিশ্বাসের অভাবে শ্রীপতি অত্যন্ত ক্ষুণ্ন হইয়া বিস্তারিতভাবে সমস্ত প্রমাণ প্রয়োগ করিতে লাগিলেন, কিন্তু কোনো ফল হইল না । উভয়পক্ষে হাঁ না করিতে করিতে রাত্রি দ্বিপ্রহর হইয়া গেল ।
যদিও কাদম্বিনীকে এই দণ্ডেই গৃহ হইতে বহিষ্কৃত করিয়া দেওয়া সম্বন্ধে স্বামী স্ত্রী কাহারো মতভেদ ছিল না , কারণ শ্রীপতির বিশ্বাস তাঁহার অতিথি ছদ্মপরিচয়ে তাঁহার স্ত্রীকে এতদিন প্রতারণা করিয়াছে এবং যোগমায়ার বিশ্বাস সে কুলত্যাগিনী — তথাপি উপস্থিত তর্কটা সম্বন্ধে উভয়ের কেহই হার মানিতে চাহেন না ।
উভয়ের কন্ঠস্বর ক্রমেই উচ্চ হইয়া উঠিতে লাগিল , ভুলিয়া গেলেন পাশের ঘরেই কাদম্বিনী শুইয়া আছে ।
একজন বলেন , “ ভালো বিপদেই পড়া গেল । আমি নিজের কানে শুনিয়া আসিলাম । ”
আর-একজন দৃঢ়স্বরে বলেন , “ সে কথা বলিলে মানিব কেন , আমি নিজের চক্ষে দেখিতেছি । ”
অবশেষে যোগমায়া জিজ্ঞাসা করিলেন , “ আচ্ছা , কাদম্বিনী কবে মরিল বলো দেখি । ”
ভাবিলেন কাদম্বিনীর কোনো-একটা চিঠির তারিখের সহিত অনৈক্য বাহির করিয়া শ্রীপতির ভ্রম সপ্রমাণ করিয়া দিবেন ।
শ্রীপতি যে তারিখের কথা বলিলেন , উভয়ে হিসাব করিয়া দেখিলেন, যেদিন সন্ধ্যাবেলায় কাদম্বিনী তাঁহাদের বাড়িতে আসে সে তারিখ ঠিক তাহার পূর্বের দিনেই পড়ে । শুনিবামাত্র যোগমায়ার বুকটা হঠাৎ কাঁপিয়া উঠিল , শ্রীপতিরও কেমন একরকম বোধ হইতে লাগিল ।
এমন সময়ে তাঁহাদের ঘরের দ্বার খুলিয়া গেল , একটা বাদলার বাতাস আসিয়া প্রদীপটা ফস্ করিয়া নিবিয়া গেল । বাহিরের অন্ধকার প্রবেশ করিয়া একমুহূর্তে সমস্ত ঘরটা আগাগোড়া ভরিয়া গেল । কাদম্বিনী একেবারে ঘরের ভিতরে আসিয়া দাঁড়াইল । তখন রাত্রি আড়াই প্রহর হইয়া গিয়াছে , বাহিরে অবিশ্রাম বৃষ্টি পড়িতেছে ।
কাদম্বিনী কহিল , “ সই , আমি তোমার সেই কাদম্বিনী , কিন্তু এখন আমি আর বাঁচিয়া নাই । আমি মরিয়া আছি । ”
যোগমায়া ভয়ে চীৎকার করিয়া উঠিলেন: শ্রীপতির বাকস্ফূর্তি হইল না ।
“ কিন্তু, আমি মরিয়াছি ছাড়া তোমাদের কাছে আর কী অপরাধ করিয়াছি । আমার যদি ইহলোকেও স্থান নাই, পরলোকেও স্থান নাই — ওগো , আমি তবে কোথায় যাইব । ” তীব্রকণ্ঠে চীৎকার করিয়া যেন এই গভীর বর্ষানিশীথে সুপ্ত বিধাতাকে জাগ্রত করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “ ওগো , আমি তবে কোথায় যাইব । ”
এই বলিয়া মূর্ছিত দম্পতিকে অন্ধকার ঘরে ফেলিয়া বিশ্বজগতে কাদম্বিনী আপনার স্থান খুঁজিতে গেল ।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ:

কাদম্বিনী যে কেমন করিয়া রানীহাটে ফিরিয়া গেল , তাহা বলা কঠিন । কিন্তু প্রথমে কাহাকেও দেখা দিল না । সমস্ত দিন অনাহারে একটা ভাঙা পোড়ো মন্দিরে যাপন করিল ।
বর্ষার অকাল সন্ধ্যা যখন অত্যন্ত ঘন হইয়া আসিল এবং আসন্ন দুর্যোগের আশঙ্কায় গ্রামের লোকেরা ব্যস্ত হইয়া আপন আপন গৃহ আশ্রয় করিল তখন কাদম্বিনী পথে বাহির হইল । শ্বশুরবাড়ির দ্বারে গিয়া একবার তাহার হৃৎকম্প উপস্থিত হইয়াছিল কিন্তু মস্ত ঘোমটা টানিয়া যখন ভিতরে প্রবেশ করিল দাসীভ্রমে দ্বারীরা কোনোরূপ বাধা দিল না- এমন সময় বৃষ্টি খুব চাপিয়া আসিল , বাতাসও বেগে বহিতে লাগিল।
তখন বাড়ির গৃহিণী শারদাশংকরের স্ত্রী তাঁহার বিধবা ননদের সহিত তাস খেলিতেছিলেন । ঝি ছিল রান্নাঘরে এবং পীড়িত খোকা জ্বরের উপশমে শয়নগৃহে বিছানায় ঘুমাইতেছিল । কাদম্বিনী সকলের চক্ষু এড়াইয়া সেই ঘরে গিয়া প্রবেশ করিল । সে যে কী ভাবিয়া শ্বশুরবাড়ি আসিয়াছিল জানি না , সে নিজেও জানে না , কেবল এইটুকু জানে যে একবার খোকাকে চক্ষে দেখিয়া যাইবার ইচ্ছা । তাহার পর কোথায় যাইবে , কী হইবে , সে কথা সে ভাবেও নাই ।
দীপালোকে দেখিল, রুগ্‌ণ শীর্ণ খোকা হাত মুঠা করিয়া ঘুমাইয়া আছে । দেখিয়া উত্তপ্ত হৃদয় যেন তৃষাতুর হইয়া উঠিল — তাহার সমস্ত বালাই লইয়া তাহাকে একবার বুকে চাপিয়া না ধরিলে কি বাঁচা যায় । আর , তাহার পর মনে পড়িল , ‘ আমি নাই , ইহাকে দেখিবার কে আছে । ইহার মা সঙ্গ ভালোবাসে , গল্প ভালোবাসে , খেলা ভালোবাসে , এতদিন আমার হাতে ভার দিয়াই সে নিশ্চিন্ত ছিল , কখনো তাহাকে ছেলে মানুষ করিবার কোনো দায় পোহাইতে হয় নাই । আজ ইহাকে কে তেমন করিয়া যত্ন করিবে । '
এমন সময় খোকা হঠাৎ পাশ ফিরিয়া অর্ধ নিদ্রিত অবস্থায় বলিয়া উঠিল , “ কাকিমা , জল দে । ” ‘ আ মরিয়া যাই! সোনা আমার , তোর কাকিমাকে এখনো ভুলিস নাই! ' তাড়াতাড়ি কুঁজা হইতে জল গড়াইয়া লইয়া খোকাকে বুকের উপর তুলিয়া কাদম্বিনী তাহাকে জলপান করাইল ।
যতক্ষণ ঘুমের ঘোর ছিল , চিরাভ্যাসমত কাকিমার হাত হইতে জল খাইতে খোকার কিছুই আশ্চর্যবোধ হইল না । অবশেষে কাদম্বিনী যখন বহুকালের আকাঙ্ক্ষা মিটাইয়া তাহার মুখচুম্বন করিয়া তাহাকে আবার শুয়াইয়া দিল , তখন তাহার ঘুম ভাঙিয়া গেল এবং কাকিমাকে জড়াইয়া ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল , “ কাকিমা , তুই মরে গিয়েছিলি ? ”
কাকিমা কহিল , “ হাঁ, খোকা । ”
“ আবার তুই খোকার কাছে ফিরে এসেছিস! আর তুই মরে যাবি নে ? ”
ইহার উত্তর দিবার পূর্বেই একটা গোল বাধিল — ঝি এক-বাটি সাগু হাতে করিয়া ঘরে প্রবেশ করিয়াছিল , হঠাৎ বাটি ফেলিয়া ‘ মাগো ' বলিয়া আছাড় খাইয়া পড়িয়া গেল ।
চীৎকার শুনিয়া তাস ফেলিয়া গিন্নি ছুটিয়া আসিলেন , ঘরে ঢুকিতেই তিনি একেবারে কাঠের মতো হইয়া গেলেন , পলাইতেও পারিলেন না , মুখ দিয়া একটি কথাও সরিল না ।
এই-সকল ব্যাপার দেখিয়া খোকারও মনে ভয়ের সঞ্চার হইয়া উঠিল — সে কাঁদিয়া বলিয়া উঠিল , “ কাকিমা , তুই যা । ”
কাদম্বিনী অনেকদিন পরে আজ অনুভব করিয়াছে যে, সে মরে নাই — সেই পুরাতন ঘরদ্বার , সেই সমস্ত , সেই খোকা , সেই স্নেহ , তাহার পক্ষে সমান জীবন্তভাবেই আছে , মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ কোনো ব্যবধান জন্মায় নাই । সইয়ের বাড়ি গিয়া অনুভব করিয়াছিল বাল্যকালের সে সই মরিয়া গিয়াছে; খোকার ঘরে আসিয়া বুঝিতে পারিল , খোকার কাকিমা তো একতিলও মরে নাই ।
ব্যাকুলভাবে কহিল , “ দিদি , তোমরা আমাকে দেখিয়া কেন ভয় পাইতেছ । এই দেখো , আমি তোমাদের সেই তেমনি আছি । ”
গিন্নি আর দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিলেন না , মূর্ছিত হইয়া পড়িয়া গেলেন । ভগ্নীর কাছে সংবাদ পাইয়া শারদাশংকরবাবু স্বয়ং অন্তঃপুরে আসিয়া উপস্থিত হইলেন; তিনি জোড়হস্তে কাদম্বিনীকে কহিলেন , “ ছোটোবউমা , এই কি তোমার উচিত হয় । সতীশ আমার বংশের একমাত্র ছেলে , উহার প্রতি তুমি কেন দৃষ্টি দিতেছ । আমরা কি তোমার পর । তুমি যাওয়ার পর হইতে ও প্রতিদিন শুকাইয়া যাইতেছে , উহার ব্যামো আর ছাড়ে না , দিনরাত কেবল ‘ কাকিমা ' ‘ কাকিমা ' করে । যখন সংসার হইতে বিদায় লইয়াছ তখন এ মায়াবন্ধন ছিঁড়িয়া যাও — আমরা তোমার যথোচিত সৎকার করিব । ”
তখন কাদম্বিনী আর সহিতে পারিল না; তীব্রকণ্ঠে বলিয়া উঠিল , “ ওগো , আমি মরি নাই গো , মরি নাই । আমি কেমন করিয়া তোমাদের বুঝাইব , আমি মরি নাই । এই দেখো , আমি বাঁচিয়া আছি । ”
বলিয়া কাঁসার বাটিটা ভূমি হইতে তুলিয়া কপালে আঘাত করিতে লাগিল , কপাল ফাটিয়া রক্ত বাহির হইতে লাগিল ।
তখন বলিল , “ এই দেখো , আমি বাঁচিয়া আছি । ”
শারদাশংকর মূর্তির মতো দাঁড়াইয়া রহিলেন; খোকা ভয়ে বাবাকে ডাকিতে লাগিল; দুই মূর্ছিতা রমণী মাটিতে পড়িয়া রহিল ।
তখন কাদম্বিনী ‘ ওগো আমি মরি নাই গো , মরি নাই গো , মরি নাই ' – বলিয়া চীৎকার করিয়া ঘর হইতে বাহির হইয়া, সিঁড়ি বাহিয়া নামিয়া অন্তঃপুরের পুষ্করিণীর জলের মধ্যে গিয়া পড়িল । শারদাশংকর উপরের ঘর হইতে শুনিতে পাইলেন ঝপাস্‌ করিয়া একটা শব্দ হইল ।
সমস্ত রাত্রি বৃষ্টি পড়িতে লাগিল; তাহার পরদিন সকালেও বৃষ্টি পড়িতেছে, মধ্যাহ্নেও বৃষ্টির বিরাম নাই । কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল , সে মরে নাই ।

Story Source- http://www.rabindra-rachanabali.nltr.org/node/2817
Read More

Monday, 29 February 2016

উপায় কী bengali poem, upay ki

Leave a Comment
উপায় কী
পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা
ধরলে সেদিন রাত দুপুরে,
ঢুকেছিল আমার ঘরে 
সত্যি বলছি দেয়াল ফুঁড়ে।
বললে আমায় তোফা আছো 
পালং জোড়া গদির পরে,
আমরা ঝুলি গাছের ডালে 
সে ডাল ভাঙে নিত্য ঝড়ে।
সেদিন সাঝে ঝিমোচ্ছিলুম
হঠাত পড়ে বাজ্খানা,
ঝলসে আমার চোখ দুটিকে 
করলে কিনা রাতকানা ?
রাতেই মোদের ধম্ম-কম্ম-
রাতেই যদি দেখতে না পাই,
পঞ্চু ভূতের খুলবে বরাত 
করবে সবই হাত সাফাই।
তাই  তো এলুম , বদ্যি খুড়ো  
বাতলিয়ে দাও সেই উপায়,
আমার ঘুঁটি বেচাল হলে 
পঞ্চু যেন কিচ্ছু না পায়।

Read More